ইট-পাথরের নগরের মাঝে মৃত্যুপথযাত্রী বুড়িগঙ্গা: বসিলা অংশে টিকে আছে এক করুণ প্রবাহ

- Update : 12:37:58 pm, Monday, 7 July 2025 21 Views

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই ভূখণ্ডের জন্ম, গঠন ও বিকাশ বহুাংশেই নদীকে কেন্দ্র করে। এক সময় যে বুড়িগঙ্গা নদী ছিল ঢাকার প্রাণ, আজ সে নদী নিজেই মৃত্যুপথযাত্রী। রাজধানীর ইট-পাথরের যান্ত্রিক জীবনের মাঝে, কংক্রিটের দালান-কোঠার ছায়ায়, বসিলা অংশে বুড়িগঙ্গা নদীর একাংশ এখনও কোনোরকমে টিকে আছে—একটি নিঃশেষপ্রায় স্রোতের প্রতীক হয়ে।
বুড়িগঙ্গা একসময় ছিল ঢাকার বাণিজ্য, পরিবহন ও জনজীবনের মূল শিরা। ছোট-বড় নৌকা, স্টিমার, লঞ্চ আর মালবাহী কার্গো যেত এই নদী দিয়ে। বসিলা, কামরাঙ্গীরচর, মোহাম্মদপুর, সদরঘাট—এই সব অঞ্চলের মানুষ নদীকে ঘিরেই গড়ে তুলেছিল জীবনের স্বপ্ন।
কিন্তু সেই নদী আজ প্রায় মৃত। কচুরিপানা, আবর্জনা, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, অবৈধ স্থাপনা আর ভূমিদস্যুদের দখলে পড়ে আজকের বুড়িগঙ্গা যেন কেবল নামেই নদী। বসিলা অংশে নদীর বুক চিরে প্রবাহিত হচ্ছে সামান্য জল, যা অধিকাংশ সময়েই স্থবির।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিন গৃহস্থালির ময়লা, রাসায়নিক বর্জ্য, স্যুয়ারেজ লাইন ও প্লাস্টিকজাত আবর্জনা সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। বসিলা এলাকায় নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে অবৈধ দালান, হাউজিং প্রকল্প এবং বালু দিয়ে ভরাটের ব্যবসা। ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষার মৌসুমে কিছুটা পানিপ্রবাহ দেখা গেলেও তা কেবল চোখে দেখার মতো, নদীর গভীরতা ও বিশুদ্ধতা আজ বিলুপ্ত।
নদীর দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পাশ্ববর্তী এলাকার সাধারণ মানুষ। বিশুদ্ধ পানির সংকট, মশার উপদ্রব, দুর্গন্ধ, পরিবেশ দূষণ ও বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ এই এলাকাগুলোতে দিন দিন বেড়েই চলেছে। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেই বলেই অভিযোগ অনেকের।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা বলেন, “আগে এই নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, এখন জাল ফেললে উঠে আসে শুধু পলিথিন।”
পরিবেশবিদদের মতে, নদীর মৃত্যু মানে আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনের এক বড় ক্ষতি। তারা বলেন, বুড়িগঙ্গার বসিলা অংশসহ পুরো নদীটিকে রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে অবৈধ দখল উচ্ছেদ, বর্জ্য ফেলা বন্ধ, নদী খনন (ড্রেজিং) এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনার মাধ্যমে পুনর্গঠন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, “নদী শুধু পানির ধারা নয়, এটি একটি সমাজ ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।”
বুড়িগঙ্গা আজ কাঁদে। বসিলার বুক চিরে যেটুকু জল এখনও বইছে, সেটি আমাদের অবহেলা, অনুশোচনা আর লজ্জার এক জীবন্ত দলিল।
যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বুড়িগঙ্গা থাকবে কেবল পাঠ্যবইয়ের পাতায়—একটি হারানো নদীর শোকগাঁথা হয়ে।