‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’—এক সময় এই স্লোগান কেবল পোস্টার কিংবা সরকারি ভাষণে শোভা পেত। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ করছে—এটি আর শুধু স্লোগান নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বাইরেও পুলিশ আজ মানবতা, সহমর্মিতা ও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতায় সমাজের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনা, দুর্যোগ, শিশু উদ্ধার, নারীর নিরাপত্তা কিংবা সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ—সবখানেই দেখা যাচ্ছে পুলিশের সক্রিয় ও মানবিক উপস্থিতি।
বিপর্যয়ে পুলিশের পাশে দাঁড়ানো: বন্যাদুর্গতদের সহায়তা
২০২৫ সালের জুন-জুলাইয়ে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নেত্রকোনার বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
স্থানীয় থানা পুলিশ, জেলা পুলিশ, রিজার্ভ ফোর্স এবং র্যাব সদস্যরা উদ্ধার ও ত্রাণকাজে এগিয়ে আসেন। অনেক পুলিশ সদস্য নিজের বেতনের টাকা দিয়ে খাবার ও ওষুধের ব্যবস্থা করেন। তারা নৌকাযোগে দুর্গম এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধ পৌঁছে দেন। শিশুদের কোলে করে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেন। এমন মানবিক ভূমিকায় পুলিশ হয়ে ওঠে জনগণের নির্ভরতার নাম।
পথশিশুর মুখে হাসি ফেরানো মানবিক পুলিশ
রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে কাঁদছিল এক পথশিশু। তাকে সান্ত্বনা দেন দায়িত্বে থাকা নারী পুলিশ সদস্য। শিশুটিকে খাবার কিনে দেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করেন এবং সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এই ঘটনা প্রমাণ করে—পুলিশ শুধু আইন প্রয়োগ করে না, বরং সমাজের প্রান্তিক ও অবহেলিতদের জন্যও একটি নিরাপদ আশ্রয়।
৯৯৯: যখন ভয় নয়, পুলিশ হয় ভরসা
জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ এখন মানুষের হৃদয়ের ঠিকানা হয়ে উঠেছে।
রাত ১০টায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী ফোন করেন—কেউ তাকে অনুসরণ করছে। মাত্র ৭ মিনিটের মধ্যে টহল পুলিশ এসে তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
৯৯৯ এখন শুধু একটি নম্বর নয়, বরং এক ‘বিশ্বাসের বন্ধু’—যার ওপারে আছে মানবিক ও তৎপর এক দল পুলিশ সদস্য।
সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে প্রযুক্তিনির্ভর পুলিশ
বর্তমানে সাইবার অপরাধ তরুণদের জন্য বড় হুমকি। হ্যাকিং, প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, পর্নোগ্রাফি—এসব মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ গঠন করেছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এবং সাইবার ওম্যান ডেস্ক।
তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করছে। অনেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সুরক্ষা পাচ্ছে। এর মাধ্যমে অনলাইন নিরাপত্তায় পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ক্রমেই বাড়ছে।
জীবন বাজি রেখে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার ফার্মগেটে চলন্ত একটি বাসে আগুন ধরে যায়। ৭ জন যাত্রী ভেতরে আটকা পড়ে। ট্রাফিক কনস্টেবল আবু রায়হান নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসে উঠে সবাইকে উদ্ধার করেন।
এই সাহসিকতার জন্য তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর মতো আরও অসংখ্য পুলিশ সদস্য প্রতিদিন নীরবে বীরত্বের দৃষ্টান্ত রেখে চলেছেন।
রক্তদান ও পুনর্বাসনে পুলিশ: মানবিকতার নিরবিচ্ছিন্ন ধারা
দেশের নানা প্রান্তে পুলিশ সদস্যরা নিয়মিত রক্তদান করছেন।
ঢাকায় এক শিশু রোগীর জন্য বিরল গ্রুপের রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচান নারী পুলিশ সদস্য ফারজানা আক্তার। খুলনার এক অফিসার ইনচার্জ নিজের বেতনের টাকা দিয়ে এক বিধবা নারীর ঘর নির্মাণে সহায়তা করেন।
এই সব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে—বাংলাদেশ পুলিশের হৃদয়ের দরজা সব সময়ই খোলা মানুষের জন্য।
বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি নিরাপত্তায় নতুন যুগ
দেশের প্রতিটি থানায় চালু হয়েছে বিট পুলিশিং সেবা। এতে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তারা নিয়মিত জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, মাদক সমস্যা, নিরাপদ স্কুলপথ—এসব বিষয় দেখভালের জন্য প্রতিটি এলাকায় বিট অফিসার রয়েছেন।
এতে করে জনগণ পুলিশকে ‘দূরের কেউ’ ভাবা বন্ধ করে দিচ্ছে—বরং ঘরের লোক, আপন মানুষের মতো দেখছে।
বাংলাদেশ পুলিশ এখন কেবল ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’ নয়—বরং তারা সমাজের ছায়াসঙ্গী।
তারা নিরবে, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন—প্রচার বা পুরস্কারের আশায় নয়, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার তাগিদেই।
যখন শহর ঘুমায়, তখনও জেগে থাকে এক দল পুলিশ। কোনো ক্যামেরা নেই, বাহবা নেই—তবুও তারা রাস্তায়, পাহারায়, মানুষের পাশে।
কারণ তারা পুলিশ। কারণ তারা আমাদের বন্ধু।
প্রকাশক ও সম্পাদকঃ হারিজ ইসলাম স্বাধীন
Design & Development By HosterCube Ltd.